শীল শব্দের অর্থ হচ্ছে চরিত্র, নিয়ম, নীতি, শৃঙ্খলা। সুশীল বালক বলতে চরিত্রবান বালককেই বোঝায়। সুতরাং একজন সৎ মানুষের চারিত্রিক গুণাবলিকে শীল বলে ।
শ্রামণ্য শীল বলতে দশশীলকে বোঝায়। অর্থাৎ শ্রামণগণ যে শীল পালন করেন তাকে শ্রামণ শীল বলা হয়। প্রত্যেক গৃহীকে একবার হলেও শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নিতে হয়। শ্রামণ বলতে শিক্ষার্থীকে বোঝায়। শ্রামণ হচ্ছে ভিক্ষু হবার প্রাথমিক স্তর। শ্রামণ হয়ে কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকতে হয়। শ্রামণদের নিত্য পালনীয় শীলই দশশীল। শ্রামণেরা সৎকর্মে রত থাকেন।
প্রব্রজিতেরা সুখের পথ খুঁজে পান। তাঁদের পুণ্যকর্ম করার যথেষ্ট সময় থাকে। তাঁদের পুণ্যকর্ম পরিশুদ্ধ থাকে। তাতে মুক্তির পথ সুগম হয়। বুদ্ধশাসনে পুত্র দান করলে মাতা-পিতার প্রভূত পুণ্য সঞ্চয় হয়। সুষ্ঠু ধর্মীয় জীবন গঠনই প্রব্রজ্যা গ্রহণের উদ্দেশ্য।
এখন আমরা গৃহীশীল ও শ্রামণ্য শীলের পার্থক্য কী তা জানব। গৃহী বা উপাসক- উপাসিকারা নিত্য পঞ্চশীল পালন করে থাকে। তারা পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টমী তিথিতে অষ্টশীলও পালন করে। সুতরাং পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গৃহীদের প্রতিপাল্য বিষয় ।
গৃহীদের মধ্যে যাঁরা প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষা নেন তাঁদের শ্রামণ বলা হয়। শ্রামণ হচ্ছে গৃহী ও ভিক্ষুর মধ্যবর্তী স্তর। ভিক্ষু হতে হলে প্রথমে শ্রামণ হতে হয়। শ্রামণদের দশশীল পালন করতে হয়। তাদের বিহারের প্রাত্যহিক কর্মও সম্পন্ন করতে হয়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে শ্রামণদের প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করতে হয়। তারপর ভালোভাবে হাত, মুখ ধুয়ে নিতে হয়। সকাল-বিকাল ভিক্ষুর নিকট দশশীল গ্রহণ করতে হয়।
এবার দশশীল কীভাবে গ্রহণ করতে হয় তা জানব।
দশশীল গ্রহণ করার সময় নতজানু হয়ে হাত জোড় করে বসতে হয়। প্রথমে ত্রিরত্ন বন্দনা করতে হয়। তারপর গুরু ভিক্ষুর নিকট দশশীল প্রার্থনা করতে হয়। আবৃত্তি করার সময় পালি ও বাংলা উচ্চারণ শুদ্ধভাবে করতে হয়।
ওকাস অহং ভন্তে, তিসরণেন সহ পজ্জা সামণের দসসীলং ধম্মং যাচামি অনুগহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে ।
দুতিযম্পি, অহং ভন্তে, তিসরণেন সহ পব্বজ্জা সামণের দসসীলং ধম্মং যাচামি অনুগহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে ।
ততিযম্পি, অহং ভন্তে, তিসরণেন সহ পব্বজ্জা সামণের দসসীলং ধম্মং যাচামি অনুগহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে ।
ভন্তে, অবকাশ প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ শ্রামণের দশশীল প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে শীল প্রদান করুন।
দ্বিতীয়বারও ভন্তে, আমি ত্রিশরণসহ শ্রামণের দশশীল প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে শীল প্রদান করুন ৷
তৃতীয়বারও ভন্তে, আমি ত্রিশরণসহ শ্রামণের দশশীল প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে শীল প্রদান করুন ।
১. পাণাতিপাতা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
২. অদিনাদানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি ।
৩. অব্রহ্মচরিযা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
৪. মুসাবাদা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি ।
৫. সুরামেরেয-মজ্জ—পমাদনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
৬. বিকাল ভোজনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
৭. নচ্চ-গীত-বাদিত-বিসুকদসনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি ।
৮. মালা-গন্ধ-বিলেপন-ধারণ মণ্ডন বিভূসনঠানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি ।
৯. উচ্চাসযন-মহাসযনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
১০. জাতরূপ রজত পটিগ্গহনা বেরমণী সিক্পদং সমাদিযামি।
১. প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
২. অদত্তবস্তু গ্রহণ (চুরি) থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৩. অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৪. মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৫. সুরা-মদ নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৬. বিকাল ভোজন থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৭. নৃত্য-গীত-বাদ্য উৎসব প্রভৃতি প্রমত্ত চিত্তে দর্শন থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৮. মাল্যধারণ, সুগন্ধ দ্রব্য লেপন, প্রসাধন দ্রব্য, অলংকার ব্যবহার থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৯. উচ্চাসন ও মহাশয্যায় শয়ন থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
১০. সোনা-রুপা গ্রহণ থেকে বিরত থাকব - এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
শীল পালনের মাধ্যমে আমরা কী শিক্ষা লাভ করতে পারি?
সর্বজীবে দয়া, আত্মসংযম, সত্যবাদিতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি নৈতিক গুণগুলো শিক্ষা লাভ করি। এ নৈতিক গুণগুলো তোমরাও অর্জন করবে। অন্যদেরও অর্জন করতে সহায়তা করবে।
দুষ্ট বালকদের তোমরা কীভাবে সৎপথে আনবে? মনে কর, তোমাদের কোনো বন্ধু ডোবার ব্যাঙকে ঢিল ছুড়ছে। কেউ বা একটি ছাগল ছানা ধরে অনর্থক মারধর করছে। মনে রাখবে, এগুলো অত্যন্ত খারাপ আচরণ। তোমরা এসব খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। এদের এভাবে কষ্ট দিবেনা। প্রাণীর প্রতি তোমাদের এই যে মমতা— এটাকেই বলে জীবে দয়া। এটা পঞ্চশীল, অষ্টশীল ও দশশীলের প্রথম শীল ।
এবার শীলবান ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একটি ঘটনা বলব। তোমরা মনোযোগ সহকারে পাঠ করবে।
অনেক দিন আগের কথা। এক ব্রাহ্মণের ছেলে তক্ষশিলায় গিয়ে বিদ্যাশিক্ষা করত। সে মনোযোগের সাথে পড়ালেখা করে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করল। পরে সেই ব্রাহ্মণপুত্র সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলে স্বীকৃতি লাভ করেন। বারাণসীর রাজা তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা শুনে তাঁকে রাজদরবারে পুরোহিতের পদে নিয়োগ করেন।
তিনি প্রতিদিন শীল পালন করতেন। কোনোদিন একটি শীলও ভঙ্গ করতেন না। রাজা- প্রজা সবাই শ্রদ্ধা করতেন। পণ্ডিত ব্রাহ্মণ চিন্তা করলেন- আমাকে সবাই কেন শ্রদ্ধা করে তা পরীক্ষা করব।
তিনি একদিন রাজভাণ্ডার থেকে একখানি সোনার কাঠি তুলে নিলেন। ধনরক্ষক তাঁকে বেশি শ্রদ্ধা করতেন বলে প্রথম দিন কিছু বলল না। তিনি তিন দিনে তিনটি সোনার কাঠি রাজভাণ্ডার থেকে অন্য জায়গায় রেখে দিলেন। তখন ধনরক্ষক তাকে রাজার নিকট বেঁধে নিয়ে বলল, ইনি রাজকীয় ধন আত্মসাৎ করেছেন। রাজা ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন- ঠাকুর, একথা কি সত্য? ব্রাহ্মণ বললেন, মহারাজ, আমি আপনার ধন আত্মসাৎ করিনি। আমার জানতে ইচ্ছা হয়েছিল, শীলবান ও বিদ্বান এ দুজনের মধ্যে কার গুণ বেশি। এখন বুঝলাম, বিদ্বানের চেয়ে শীলবান বা চরিত্রবানই শ্রেষ্ঠ।
রাজা ব্রাহ্মণের প্রশংসা করলেন। তিনি তাঁকে ছেড়ে দিলেন। ব্রাহ্মণ তাঁর কর্তব্য সততার সাথে সম্পন্ন করতে লাগলেন। বল তো এই ব্রাহ্মণ কে? ইনি ছিলেন বোধিসত্ত্ব (গৌতম বুদ্ধ)। তিনি তাঁর পূর্ব জন্মের একটি উদাহরণ দিয়ে কাউকে চুরি না করার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন।
বিদ্যা এবং চরিত্র দুটোই মানুষের অমূল্য সম্পদ। চরিত্রহীন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তার কোনো মূল্য নেই। তোমরাও বিদ্যা অর্জনের সাথে সাথে নিজেদের চরিত্র গঠন করবে। শীল হচ্ছে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার।
এবার শীল পালনের সুফল সম্পর্কে জানব।
একসময় বুদ্ধ ধর্ম প্রচার মানসে পাটলি গ্রামে উপস্থিত হন। তথায় উপাসক-উপাসিকারা বুদ্ধকে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য দান করেন। বুদ্ধ ভোজন শেষে তাদের উদ্দেশ্যে শীল পালনের সুফল বর্ণনা করেন। শীল পালনের সুফলগুলো নিম্নরূপ :
১. শীলবানদের শীল পালনের সুকীর্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
২. শীল পালনের দ্বারা সৎপুরুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়।
৩. শীলবান ব্যক্তিরা সর্বদা নির্ভয় থাকে। নিঃসঙ্কোচে ও প্রফুল্ল চিত্তে যথা তথায় উপস্থিত হন।
৪. শীলবানেরা সজ্ঞানে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. তাঁরা মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে উৎপন্ন হন।
৬. তাঁরা অপরের উপকার সাধন করে পুণ্য অর্জন করেন।
৭, তাঁদেরকে সবাই শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁরা সকলের প্রশংসা অর্জন করেন।
তোমরা দুঃশীল বা চরিত্রহীন লোকের কী কী ক্ষতি হয় জান ?
১. সে পাপ কাজ করে সৎবন্ধু হারায়।
২. সকলে তাকে নিন্দা করে।
৩. সে মৃত্যুর পর দুর্গতি প্রাপ্ত হয়।
৪. সে অত্যন্ত দুঃখের মধ্যে দিন কাটায় ।
৫. তার দুর্নাম সর্বত্র প্রচারিত হয়।
জগতে সবাই সুখ চায়। দুঃখ কেউ চায় না। সুখ পেতে হলে সচ্চরিত্রবান হবে। পুণ্য পথে চলবে। এতে তোমরা ইহকাল ও পরকালে শান্তি লাভ করবে।
১. শ্রামণ্য শীল ভিক্ষু জীবনের ___ স্তর ।
২. শ্রামণদের নিত্য ___ শীলই দশশীল ।
৩. শ্রামণ হচ্ছে গৃহী ও ভিক্ষুর ___ স্তর।
৪. এখন বুঝলাম, বিদ্বানের চেয়ে ___ শ্রেষ্ঠ ।
৫. শীলবানেরা সজ্ঞানে ___ করেন।
বাম | ডান |
---|---|
১. প্রব্রজিতেরা সুখের পথ ২. পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গৃহীদের ৩. গৃহীরা পরিবার-পরিজন ৪. অনুগ্রহ করে আমাদের ৫. দুঃশীল ব্যক্তি মৃত্যুর পর ৬. শীলবানেরা সজ্ঞানে | ১. নিয়ে বাস করে। ২. মৃত্যুবরণ করেন । ৩. শীল প্রদান করুন। ৪. প্রতিপাল্য বিষয় । ৫. খুঁজে পায় । ৬. জীবন গঠন করতে হয়। ৭. দুর্গতি প্রাপ্ত হয়। |
১. সুশীল বালক বলতে কাকে বোঝায়?
২. শ্রামণ্য শীল কাকে বলে?
৩. দশশীল কাদের পালন করতে হয়?
৪. নৈতিক গুণের তিনটি উদাহরণ দাও।
৫. পালি ‘মুসাবাদা’ শব্দের বাংলা অর্থ কী?
৬. ব্রাহ্মণের ছেলেকে রাজপরিবারে কী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল?
১. শীলবান ব্যক্তির বিশেষ গুণগুলো তুলে ধর।
২. গৃহী শীল ও শ্রামণ্য শীলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।
৩. দশশীল কীভাবে গ্রহণ করতে হয় বর্ণনা কর।
৪. দশশীলের বাংলা অনুবাদ লেখ ৷
৫. শীলবান ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কাহিনীটি বর্ণনা দাও ৷
৬. শীল পালনের পাঁচটি সুফল উল্লেখ কর।
Read more